

সমুদ্রসৈকতে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে স্নান করা, যখন ইচ্ছা পার্কের বেঞ্চিতে নগ্নাবস্থায়ই সটান শুয়ে পড়া কিংবা নগ্নতাবাদ নিয়ে আস্ত একখানা স্কুলই খুলে ফেলার কথা ভাবতে পারছেন? শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর আরও বহু দেশ, এমনকি খোদ আমেরিকানরাও ভাবতে পারেন না জনসম্মুখে এ ধরনের স্টান্ট নেওয়ার কথা।
তারা না পারলেও জার্মানরা কিন্তু দিব্যি নিজেদের প্রকাশ করে যাচ্ছেন যখন যেভাবে খুশি, সেভাবেই।
প্রথাগত আমেরিকান সংস্কৃতিতে যেখানে নগ্নতাকে এক রকম যৌনতা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, সেখানে জার্মানরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে যেখানে সেখানে নগ্নতার প্রকাশকে খুবই স্বাভাবিক চোখে দেখেন। জার্মানিতে সমুদ্রসৈকতগুলোতে গেলে আপনি দেখতে পাবেন, সেখানে সুইমিং স্যুট মানে হয়ে গেছে ‘জন্মদিনের পোশাক’; অর্থাৎ অনেকের গায়েই একটি সুতোও নেই।
ম্যাসাজ থেরাপি নেওয়ার আগে যদি আপনি সেখানে কাপড় খোলার জন্যে থেরাপিস্টের অনুমতির অপেক্ষায় থাকেন, তাহলে তারা নিশ্চিত আপনাকে অদ্ভুত একজন মানুষ বলেই ধরে নেবেন!
কিন্তু নিজের প্রথম গণনগ্নতার সাক্ষী হবার মুহূর্ত কে-ই-বা ভুলতে পারে! এই যেমন, আমেরিকান সাংবাদিক ক্রিস্টিন আর্নেসনের প্রথমবার এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল বার্লিনের সাউদার্ন নিউকোন অঞ্চলের হাসেনহাইডের এক পার্কে জগিং করতে গিয়ে। হঠাৎ তিনি দেখলেন, একদল লোক নগ্ন অবস্থায় বিকেলের প্রখর সূর্যের নিচে সূর্যস্নান করছেন। পরবর্তীকালে এই আমেরিকান আবিষ্কার করলেন, শহরের কোনো এক প্রান্তে চমৎকার কোনো পার্কে বা সমুদ্রসৈকতে গিয়ে এই কাজ করা বার্লিনের একটি রেওয়াজ!

আমরা যদি ইতিহাসের পাতা উল্টে পেছনে তাকাই, তাহলে জানা যায়, প্রকৃতির মাঝে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে দেওয়ার প্রক্রিয়াটি মানুষের ভেতরে এক ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তোলে, আবার সেইসঙ্গে প্রশান্তিও এনে দেয়।
তবে হাসেনহাইডের পার্কের এই দৃশ্যই জার্মানির ‘হেডোনিস্টিক’ বা আনন্দবাদী দিক নয়, বরং তা ‘ফ্রি বডি কালচার’-এর একটি উদাহরণ। এই ‘ফ্রি বডি কালচার’ বা ‘মুক্ত দেহ সংস্কৃতি’কে জার্মানরা বলে থাকে ‘Freikörperkultur’; সংক্ষেপে ‘এফকেকে’।
এফকেকে বিষয়টি আসলে জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকের (পূর্ব জার্মানি বা জিডিআর) সঙ্গে ঘনিষ্ঠরূপে সম্পর্কযুক্ত। তবে জার্মানিতে নগ্নতাবাদের প্রকাশ্য চর্চা শুরু হয় উনবিংশ শতকে। সমুদ্রসৈকতে নিজের উর্ধ্বাঙ্গের জামা খুলে ফেলার রীতি থেকে শুরু করে এফকেকে একটি বৃহৎ জার্মান আন্দোলন এর জন্ম দেয়। এই আন্দোলনের মূলতত্ত্ব ছিল, প্রকৃতির মাঝে নিজেকে মুক্ত করে দিলে অনেক চাপ ও দুশ্চিন্তা থেকে আত্মাকে মুক্ত করা যায়।
বার্লিনের ফ্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আর্নড বাওয়ারক্যাম্পার জানালেন, ‘নগ্নতা বহু আগে থেকেই জার্মান সংস্কৃতির একটি অংশ।’ বিশ শতকের শুরুর দিকে লেবেনসরিফর্ম (ইংরেজিতে ‘লাইফ রিফর্ম’, জীবনের পুনর্গঠন) নামক একটি তত্ত্ব জার্মানিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এর দর্শনটি ছিল- প্রাকৃতিক খাদ্য, যৌন স্বাধীনতা, বিকল্প ঔষধ এবং প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে অতি সাধারণ জীবনযাপন।
বাওয়ারক্যাম্পার বলেন, ‘নগ্নতা আসলে সেই আন্দোলনেরই একটি প্রসারিত দিক, যা শিল্পযুগের আধুনিকতা ও উনবিংশ শতকে নব-উদীয়মান সমাজের বিরুদ্ধে যাওয়া একটি প্রচেষ্টা।’

লিবনিজ সেন্টার ফর কনটেম্পোরারি হিস্টোরি পোস্টড্যামের ইতিহাসবিদ হ্যানো হসমিউথের মতে, এই পুনর্গঠন আন্দোলন বার্লিনসহ বড় শহরগুলোতে বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল, যদিও বার্লিন তার কান্ট্রি লিভিং পদ্ধতি নিয়ে বেশ রোমান্টিসিজমে ভুগত। ওয়েইমার যুগে (১৯১৮-১৯৩৩) এফকেকে সমুদ্রসৈকতগুলোতে সূর্যস্নানকারী মানুষের সংখ্যা থাকত খুবই কম, যার মধ্যে বুর্জোয়া দলের সদস্যই ছিল বেশি। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জার্মানির সাম্রাজ্যবাদ (১৮৭১-১৯১৮) ও তার পুরাতন নিয়মনীতির কঠিন বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছিল মানুষ।
১৯২৬ সালে আলফ্রেড কচ নামের এক জার্মান ভদ্রলোক খুলে বসেন ‘বার্লিন স্কুল অব নুডিজম’, যেখানে নানা লিঙ্গের মানুষেরা একসঙ্গেই নগ্নতা চর্চা করতে পারবেন। তারা বিশ্বাস করতেন, উন্মুক্ত স্থানে নগ্নতা চর্চা করলে তা প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে এক ধরনের ছন্দ বজায় রাখতে সাহায্য করে।
কিন্তু জার্মানিতে নাৎসি মতাদর্শ চলতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে অনৈতিকতার জন্ম দিচ্ছে- এই দায়ে এফকেকে’কে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৪২ সালে থার্ড রাইখের সময়ে আবার নগ্নতার ওপর কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করা হয়, যদিও হিটলারের নিষিদ্ধ করা গোষ্ঠীগুলো, যেমন ইহুদী এবং কমিউনিস্টদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আগের মতোই বজায় ছিল।
কিন্তু এরপরও যুদ্ধ পরবর্তী জার্মানির দুই অংশ- পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিতে কয়েক শতক লেগে গিয়েছিল এফকেকে’র পূর্ণ প্রকাশ ঘটতে। বিশেষত পূর্বাংশে বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে নগ্নতা নিয়ে আর কোনো বাধা ছিল না। কমিউনিস্ট অধ্যুষিত জার্মান অঞ্চলে যেখানে ভ্রমণ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ভোগ্যপণ্যের কেনাবেচায় বিস্তর বাধ্যবাধকতা ছিল, সেখানে এই এফকেকে চর্চা একটি ‘সেফটি ভালভ’ হিসেবে কাজ করত বলে জানান অধ্যাপক বাওয়ারক্যাম্প। একটি কড়া নিষেধাজ্ঞার জালে আবদ্ধ এক রাজ্যের মধ্যে এটি সামান্যতম ‘মুক্ত চলাচলে’র আনন্দের ছোঁয়া দিয়েছিল।

১৯৭১ সালে এরিখ হোনেকার ক্ষমতায় এসে ফ্রি বডি কালচারকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেন। এর আগ পর্যন্ত পূর্ব জার্মানিবাসীদের সমুদ্রসৈকতে নগ্ন সূর্যস্নান নিতে নিতে চোখ-কান খোলা রাখতে হতো, পুলিশ আসছে কি না! হোনেকারের সময় থেকেই পূর্ব জার্মানিতে নতুন পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করা হয়, যা তাদের বহির্বিশ্বের কাছে আরও উপযোগী করে তোলে। তারা বোঝাতে চেয়েছিলেন, হ্যাঁ, আমরা নগ্নতাবাদকে অনুমোদন করছি। তার মানে, জার্মানি এখন একটি মুক্তচিন্তার দেশ।
১৯৭০ ও আশির দশকে পূর্ব জার্মানি সরকার এফকেকে’কে আরও খোলামেলাভাবে চর্চা করার অনুমোদন দেয়।
কিন্তু পূর্ব জার্মানি ১৯৯০ সালে পশ্চিমের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় আবার বাধা আসতে থাকে এবং ফ্রি বডি কালচার হ্রাস পায়। সত্তর ও আশির দশকে হাজার হাজার নুডিস্ট তাদের ক্যাম্পগ্রাউন্ড ছেড়ে চলে যান। ২০১৯ সালেও জার্মান অ্যাসোসিয়েশন ফর ফ্রি বডি কালচার মাত্র ৩০ হাজারের কিছু বেশি লোককে সদস্য হিসেবে রেজিস্টার করিয়েছে। এদের বেশিরভাগের বয়সই ৫০-৬০ বছরের মধ্যে।
কিন্তু সংখ্যায় কমতে থাকার মধ্যেও এফকেকে সংস্কৃতি জার্মান সংস্কৃতিতে একটি বড় রকম প্রভাব রেখে যাচ্ছে, বিশেষত সাবেক পূর্বাঞ্চলে। এমনকি এখনো তারা খবরের শিরোনামে ভাইরাল হতে সক্ষম। এই যেমন, বার্লিন লেকের কাছে এফকেকে অঞ্চলে নগ্ন অবস্থায় থাকা এক সদস্যকে বুনো জন্তুর পেছনে দৌড়াতে হয়েছে, কারণ জন্তুটি তার ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়ে ভেগেছিল!

জার্মানিতে নগ্নতাবাদের এই লম্বা ইতিহাস ও এখনো পর্যন্ত জনসম্মুখে নগ্নতা প্রদর্শনের ব্যাপারে তাদের সহনশীলতা সারা বিশ্বেই এক নতুন পরিচয়। ক্লথিং ফ্রি স্পেস ও গণনগ্নতাকে নিজেকে ভালো রাখার এক ধরনের উপায় বলে মনে করা হচ্ছে।
বিভিন্ন তালিকা প্রদানকারী সাইট Nacktbaden.de সমগ্র জার্মানিতে নগ্ন অবস্থায় সময় কাটানোর মতো কোন কোন সমুদ্রসৈকত, পার্ক, পাহাড়ে হাইকিং স্পট রয়েছে- তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। আপনি চাইলেই একবার সেখানে ঢুঁ মেরে দেখতে পারেন।
পূর্ব জার্মানির অনেকেই এখনো মনে করেন, নগ্নতা প্রকাশের চর্চা তাদের অন্তরের ভেতরে প্রোথিত হয়ে রয়েছে। তারা মনে করেন, নিজের শরীর প্রকাশের মধ্যে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা মানহানিকর কিছু নেই। নগ্নতা প্রকাশ্যে দেখা নিজের মধ্যে একটি বোধ জাগ্রত করে, যা মানুষকে বাহ্যিক রূপের বাইরে গিয়ে ভাবতে শেখায় এবং শরীর সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি।
আমরা সাধারণত যেভাবে দেখে অভ্যস্ত, ফ্রি বডি কালচার তার বাইরে গিয়ে আলাদা করে মানুষকে দেখার ও গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে তোলে, এ রকমটাই জার্মানদের ধারণা।
Be the first to write a comment.